নাটক- যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল
পরিচালক- সৌরভ পালোধী
অভিনয়ে- তূর্ণা দাস, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাস, কৃষ্ণেন্দু সাহা, বিমল চক্রবর্তী, প্রমুখ
বড় হতে না হতেই আমরা অনেকেই 'লেবড়ে ফেলেছি' ইতিমধ্যেই, আর সৌরভ পালোধীর যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল তার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ‘তার’ কাছে পৌঁছে দিল। কার কাছে? ছোটবেলার। ৯০ এর দশক কিংবা নতুন শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকে, যেখানে জীবন এতটা জটিল ছিল না, যেখানে সব কিছু নিয়ে এত মতামত ছিল না, যেখানে এত কিছু বুঝতাম না। ছিল লোডশেডিং আর গল্প, ছিল বিকেলের খেলা, ছিল দুর্গাপুজোর প্রাণ ভরা মজা, মায়ের আদর, বাবার কাছে আবদার এবং আরও অনেক, অনেক কিছু। কিন্তু ওই 'আমরা একদিন হঠাৎ করেই বড় হয়ে যাই', আর সবটা কেমন ঘেঁটে যায়। এই ঘেঁটে যাওয়া, দমবন্ধ সময়ে ইচ্ছেমতো নাট্যদলের এই নতুন নাটক 'যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল' যেন এক টুকরো মন ভালো করা দমকা বাতাস।
আমরা যারা ৮০-৯০ এর দশকের ছেলেমেয়ে তাদের কাছের কাছে এই নাটক নস্টালজিয়া, হাত ধরে ছোটবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। হাসাবে, কাঁদাবে, মিল খুঁজে এনে দেবে, আর সব শেষে দু'চোখ ছাপিয়ে যখন জল উপচে পড়বে তখন কেউ জিজ্ঞেস করলে এতগুলো অনুভূতি একসঙ্গে দলা পাকিয়ে উঠে আসবে যে স্রেফ একটাই কথা বলা যাবে 'বলতে পারিনি কেন কান্না পায়।'
কী নিয়ে 'যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল'র গল্প?
সোমা, বুবান, তাতিন এবং টুবাই- এরা হল চার বন্ধু। দক্ষিণ কলকাতার একটি কলোনি পাড়ায় এদের বেড়ে ওঠা। বুবান, তাতিন বাকি দুজনের থেকে সামান্য ছোট হলেও, তাদের বন্ধুত্ব দারুণ। একসঙ্গেই বেড়ে ওঠা তাদের। আর এই বেড়ে ওঠার সঙ্গে নিজেদের মধ্যে বদল আসা, সম্পর্কের রসায়ন বদলে যাওয়া, ব্যস্ততা, দূরত্বের সঙ্গে রাজনীতি, সামাজিক নানা ঘটনা মিলেমিশে একাকার, ১৯৯৮ সাল থেকে চলতে চলতে ২০১৯ পর্যন্ত ৪ বন্ধুর জীবনে কী কী বদল এল, কী হয় তাদের বন্ধুত্বের পরিণতি সেটা নিয়েই এই নাটক। সঙ্গে আরও ছোট ছোট সাবপ্লট আছে। আসলে সময়ের এই এগোনো পিছনোর মধ্যে দিয়ে কখন যে আপনি নিজে আপনার ছোটবেলা, কিংবা কৈশোরে ফিরে যাবেন ধরতে পারবেন না!
কেমন লাগল 'যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল'?
'যে জানলাগুলোর আকাশ ছিল'-কে নিয়ে যখন লিখতে বসলাম বেশ অনেকটা সময় লাগল, কেবল এটুকু ভাবতে যে শুরু কোথা দিয়ে করব। নাটকের মঞ্চ সজ্জা থেকে আলো, ছোট খাটো বদল থেকে পরিচিত গান কিংবা অরিজিন্যাল গানের ব্যবহার সবটাই অসাধারণ। তবে ঋষি পান্ডার গাওয়া জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েলের বাংলা ভার্সনের ব্যবহারটা অনবদ্য। দেবদীপ মুখোপাধ্যায় যে অতি যত্ন নিয়ে এই নাটকের গান করেছেন সেটা বেশ ভালো রকম বোঝা গিয়েছে। সৌরভ পালোধীর পরিচালনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, তবুও বলি যেটা দেখে এলাম সেটা কেবল সব দারুণ উপাদান থাকলেই হতো না, উনি ভালো রাঁধুনি বলেই এত সুন্দর রাঁধতে থুড়ি তাঁর নির্দেশনায় সুন্দর করে পরিবেশন করতে পেরেছেন।
এবার আসি অভিনয়ে, দুটো পুঁচকে যারা কখনও সোমা, বুবান বা তাতিনের চরিত্রে অভিনয় করেছে তাদের জন্য একরাশ ভালোবাসা। কী যে মিষ্টি! বিশেষ করে ছোট্ট ঋদ্ধায়ন বড্ড বেশিই মিষ্টি! তূর্ণা দাসের চরিত্র অর্থাৎ সোমার চরিত্রের শুরু থেকে শেষের বদল, ওই সংলাপ, চরিত্রের ওই দৃঢ়তার সঙ্গে বলিষ্ঠ সংলাপ গায়ে কাঁটা দেওয়ায়। তাতিনের চরিত্রে কৃষ্ণেন্দু সাহা যথাযথ। রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় টুবাই দা হিসেবে ভালো। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন বুবানের চরিত্রে থাকা বুদ্ধদেব দাস। আমি এই নাটক আরও দশবার দেখতে পারি কেবল ওঁর অভিনয় দেখার জন্য। আহা, কী নিখুঁত, কী এক্সপ্রেশন, কী ভয়েস মডিউলেশন। নাটকের শেষ দিকে ওঁর দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়। ওঁর সঙ্গে দর্শকরাও হাসবেন, কাঁদবেন, আবেগে ভাসবেন।
এই নাটকের একটি দৃশ্যে দেখা যাবে সোমার চরিত্রের ছোট এবং বড়বেলা একসঙ্গে গান গাইছে, গান গাইতে গাইতে অন্যদের সংলাপ চলে আসায় তাদের ভলিউম কমে যাবে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে দরাজ গলায় গাইতে গাইতে ভলিউম কমিয়ে একই ভাবে গেয়ে যাওয়া, আবার শেষের দিকে গিয়ে ভলিউম বাড়ানো দেখে মুগ্ধ হতে হয়। দেখে মনে হবে যেন টিভি দেখতে দেখতে আচমকা জরুরি ফোন আসায় রিমোট দিয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিল কেউ। হ্যাঁ, এতটাই নিখুঁত। ধুনুচি নাচের একটি জায়গা আছে যেখানে স্লো মোশনে ওদের চার বন্ধুকে নাচতে দেখা যাবে, সেই দৃশ্যও যে ঠিক কতটা মায়াবী, সুন্দর বলে বোঝানো যাবে না। তবে তিনটি জায়গার কথা না বললেই নয়। অপু বলে একটি চরিত্রের আত্মহত্যার দৃশ্য, শেষ দৃশ্যে বুবানের চরিত্রের অভাবনীয় অভিনয় এবং NRC CAA প্রসঙ্গ নিয়ে সোমার চরিত্রের বলা সংলাপ মনে দাগ কাটতে বাধ্য। এছাড়া এমন কিছু সংলাপ বা মুহূর্ত আছে যা আলাদা করে ভালো লাগবে। বুবানের বাবা দাদুর চরিত্রে থাকা আদিত্য নন্দী এবং বিমল চক্রবর্তীর রসায়ন,খুনসুটি মন ভালো করবে।
আজ যখন সত্যিই এই রুক্ষ পৃথিবীর ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ভীষণরকম অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছি, কান্না আসে না, কারও চলে যাওয়া আঘাত দেয় না, কিছু হারানোর যন্ত্রণা অনুভূত হয় না তখন এই নাটক চোখের কোণে জল এনে দেয়। এক অন্যরকম মনে ভালো (নাকি খারাপ) করা অনুভূতি এনে দেয়, ফুরফুরে মেজাজে নাটকের চরিত্রগুলোকে মনে নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়।