২০০৪ সালে বইমেলায় আলাপ হয় শ্রীজাত এবং দূর্বার। বই আর প্রেমের গন্ধ মিলে মিশে একাকার। পরের বছরই শুভদিন দেখে বিয়েটা সেরে নিয়েছিলেন দুজনে। ২০০৫ সালের ১৪ই জুন সাত পাকে বাঁধা পড়েছিলেন শ্রীজাত-দূর্বা। দেখতে দেখতে দাম্পত্যের ১৯ বছর পার করে ফেলেছেন তাঁরা।
দুজনের সম্পর্কের রসায়ন বরাবরই মন কাড়ে নেটিজেনদের। নিঃসন্তান এই দম্পতি পরস্পরের হাত শক্ত করে ধরে রয়েছেন জীবন পথে। শনিবার, ২১শে ডিসেম্বর জীবনের আরও একটা বসন্ত পার করে ফেললেন শ্রীজাত। এদিন কবি ৫০-এ পা দিলেন। তাঁর জন্মদিনে বরের জন্য মনের ঝাঁপি উজার করে দিয়েছেন কবি-পত্নী, দূর্বা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, শ্রীজাতর প্রথম প্রেম লেখালেখি। তবে লেখালেখি আর স্ত্রী দুজনকেই দরকার। দুজনেরই গুরুত্বসমান।
বছর খানেক আগে শ্রীজাতকে বলতে শোনা গিয়েছিল, দূর্বা অন্য কারুর প্রেমে পড়লে তিনি রাগ করবেন না, বরং বুঝবেন বউয়ের মন এখনও ‘সজীব আছে’। এদিন শ্রীজাতকে নিয়ে খুল্লমখুল্লা দুর্বা। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি জানান, ‘মানুষ মাত্রেই বহুগামী। একাধিক প্রেম থাকাটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি, মানুষ বলেই আমরা নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাই না।'
কবি-পত্নীর কথায়, তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব আর বোঝাপড়া অটুট সেই কারণেই তাঁরা ‘চরম ভালো’ আছেন। অকপটে বললেন, 'শ্রীজাতকে প্রচুর জন প্রচুর প্রেম নিবেদন করেন। কবিরও মাঝেমধ্যে কাউকে কাউকে মনে ধরে যায়। তাই নিয়ে পরে আমরা আলোচনা, হাসাহাসি— সবই করি।’
বর কবি বলে তাঁর জন্য ভুরি ভুরি রোম্যান্টিক কবিতা লেখেন এমনটাও নয়। তবে নিশ্চিতভাবেই বউয়ের জন্য কবিতা লেখেন শ্রীজাত। কিন্তু সে-সব প্রকাশ্যে আনেন না। দর্শন নিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করে যাদবপুর থেকে পিএইচডি করেছেন দূর্বা। একটি এনজি-ওর প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসাবে বর্তমানে কর্মরতা তিনি।

দিন কয়েক আগেই দূর্বার সঙ্গে শেষবয়সের দাম্পত্য জীবনের পরিকল্পনা ফাঁস করেছিলেন শ্রীজাত। জানিয়েছিলেন, প্য়ারিসে শেষ বয়সটা কাটানোর ইচ্ছে দুজনের। লিখেছলেন, ‘শেষমেশ অনেক দরাদরি ক’রে আমরা এ-দুয়ের মাঝামাঝি একখানা জায়গা ঠিক করেছি। প্যারিস। আমাদের শেষ বয়সটা আমরা প্যারিসে কাটাব। কোনও একটা ছিমছাম স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট হলেই চলে যাবে আমাদের, তবে হ্যাঁ, শহরের মাঝখানটিতে হওয়া চাই। সকাল সকাল অল্প ঠান্ডা হাওয়ার বিরুদ্ধে একখানা মাফলার চাপিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথের ধারের ছোট কোনও ক্যাফে-তে বসব। হালকা প্রাতঃরাশ আর কাপ-দুয়েক কড়া কালো কফি’র পর এমনিই এলোমেলো হাঁটব দু’জন। যেদিকে দু’চোখ আর চার-পা যায়। তাড়া তো নেই কোনও। তাড়া থাকে দু-ধরনের লোকের। এক, যারা কেজো আর দুই, যারা ট্যুরিস্ট। আমরা এর কোনওটাই হবো না। একখানা নির্ভার কাজহীন পথিকের জীবন কাটাব আলস্যে, প্যারিসে’।
তিনি আরও লেখেন, ‘কিন্তু সেই ‘শেষ বয়স’-টা ঠিক কবে আর কখন শুরু হচ্ছে, তা জানব কী ক’রে? এ এক মস্ত ধাঁধা। আমরা আমাদের জীবনের আয়ুরেখাকে একটা সোজা আর টানটান সুতোর মতোই দেখতে ভালবাসি। অনেক জল্পনা থাকে আমাদের। চল্লিশের কোঠায় এই করব, পঞ্চাশের ঘরে এই করব, ষাট পেরোলে তমুকটা সেরে ফেলতে হবে, তারপর শেষ বয়সটা নিজের মতো করে কাটাব। খুব ভাল কথা। পরিকল্পনা তো থাকাই উচিত। কিন্তু জীবন নামক যে-অদৃশ্য পরিচালক এই মহান থিয়েটারটি চালাচ্ছেন, তিনি বিনে আর কেউ কি জানে, কোন দৃশ্যে শেষ সংলাপ ব’লে মঞ্চ থেকে চিরতরে চলে যেতে হবে? কেউ জানে না। তাই এখন বুঝতে পারি, এমন কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই, যাকে ‘শেষ’ ব’লে আগাম দাগিয়ে রাখা যায়। যাকে আমি ভাবছি তারুণ্য, সেটাই হয়তো আমার শেষ বয়স। হয়তো প্রৌঢ়ত্বের সন্ধে আমার দেখা হবে না। বা মাঝবয়সে এসে যখন অবসরের আঁক কষছি সবে, হয়তো সেটাই আমার শেষ বয়স। তাই আমার তত্ত্ব খুব সিধে, যা-কিছু ইচ্ছে, সব কিস্তিতে মিটিয়ে নিতে থাকো, যদি সম্ভব হয়।’
দূর্বার সঙ্গে দাম্পত্য নিয়ে তাঁর মত সবসময় মেলে না। কিন্তু মন মেলে। কবি শেষ করেন, 'ওই সব খাতা-পেনের তর্কের কাটাকুটি পেরিয়ে আমি দেখতে পাই, আমাদের দু’জনের মন ততক্ষণে পৌঁছে গেছে প্যারিস। তারা বলছে, ‘তোরা বাড়িতে ব’সে ঝগড়া কর গে যা, এই আমরা বসলুম নদীর ধারের বেঞ্চিতে। যখন আসবি, খুঁজে নিস’। আমরাও কলকাতার ব্যস্ততার সোয়েটার থেকে আলগা উলের মতো বেরিয়ে পড়ার ফিকির নিয়ে বেঁচে থাকি, কবে পৌঁছব ফরাসি সেই নদীর ধারের বেঞ্চির পাশটিতে, আর একে অপরের হাত ধরে বলতে পারব, ‘আয় মন, বেড়াতে যাবি!’