প্রতিদিনের ইঁদুর দৌড়, প্রবল ব্যস্ততা, কাকে পিছনে ফেলে কতটা এগিয়ে গেলাম, এই রোজের রেসে কতটা পিছিয়ে থাকলাম, সংসারের চিন্তা সবটা পিছনে ফেলে ছেলেবেলার সেই নির্ঝুম দুপুরগুলো ফিরে যেতে চান? যেখানে গল্পের বইয়ের চরিত্ররাই আপনি। যেখানে রূপকথা আছে, আছে অ্যাডভেঞ্চার, অদ্ভুতুড়ে সব চরিত্র, পক্ষীরাজ আর এক টুকরো ফেলে আসা ছেলেবেলা? তাহলে সৌকর্য ঘোষালের নতুন ছবি পক্ষীরাজের ডিম আপনাকে নিরাশ করবে না।
কেমন হল ‘পক্ষীরাজের ডিম'?
একটা সময় শিশু-মন বেড়ে উঠত সহজ-সরল কল্পনার রাজ্যে। সেখানে লোডসেডিং থাকত, ঠাকুমা-দাদুর কাছে সেই অন্ধকারে বসে গল্প শোনার রোমাঞ্চ থাকত, প্রকৃতির মাঝে, তাকে ঘিরে বড় হত ছোটোবেলা। তবে এখন অট্টালিকার গোলকধাঁধা আর স্মার্ট ফোনের রিলসের আগ্রাসনে হারিয়েছে খেলার মাঠ। খুদেরা মাঠে খেলার বদলে, ফোনের মধ্যে থাকা ব্যাটেল গ্রাউন্ডে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলেই সময় কাটায়। গ্রাফিক্স, ভিএফএক্সের ম্যাজিকে মুষড়ে পড়ে কল্পনাপ্রবণ মন আর রূপকথার রাজ্য। আর এই জায়গাতেই 'পক্ষীরাজের ডিম' যেন সেই ফেলে আসা ছেলেবেলার অনুভূতির আয়না হয়ে ফিরে আসে। 'পক্ষীরাজের ডিম' কেবল 'ঘোতন', 'পপিন্স'-দের নয়, বরং দর্শকদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কল্পনাপ্রবণতা মনকেও তাঁদের সামনে এনে দাঁড় করায়।
এই ছবি 'রেনবো জেলি'র সিক্যুয়াল তা সকলেই জানেন। 'রেনবো জেলি'তে পরী পিসি এসেছিল সাত রঙের, সাত স্বাদের খাবার নিয়ে, যা একটা মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনে। আর এই 'পক্ষীরাজের ডিম' যেন তারই উল্টোপিঠ। ছবিতে ঘোতন,পপিন্স এখন অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। কলকাতার নানা স্কুলে চেষ্টা করেও ঘোতনের সুযোগ না মেলায় সে আকাশগঞ্জে এসেছে। শুধু এসেছে বললে ভুল হবে, সে এখন আকাশগঞ্জ স্কুলের ছাত্রও। এবার সে মাধ্যমিক দেবে। তবে ঘোতন অঙ্কে বড়ই কাঁচা। তার উপর মাধ্যমিকের টেস্টে জিরো পেয়েছে। স্কুলের হেডমাস্টার মশাই বলেছে আর একটা অঙ্কের পরীক্ষা যদি বটব্যাল স্যার নেয়, আর সেখানে যদি সে পাশ করতে পারে, তবেই সে মাধ্যমিক দিতে পারবে, না হলে নয়।
এদিকে 'পপিন্স' এখনও কলকাতাতেই থাকে। ফোনে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে ঘোতনকে ভূগোলও পড়ায়। কিন্তু ঘোতনের এই জিরো পাওয়া নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। তাই ঘোতনকে পড়ায় সাহায্য করতে আর বটব্যাল স্যারকে ঘোতনের জন্য ফের অঙ্ক পরীক্ষা নিতে রাজি করানোর জন্য কলকাতা থেকে আকাশগঞ্জে এসে হাজির হয়। আর এই সব কিছুর মাঝেই ঘোতনের হাতে আসে 'পক্ষীরাজের ডিম'। সেই ডিম সে বটব্যাল স্যারকে দেয়। অন্যদিকে, এই ডিমের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এক বিদেশি প্রত্নতাত্বিকও 'ভিলেন স্যার'। আর তারপর ঘটতে থাকে একের পর এক সব অবাক করা ঘটনা। কিন্তু এই সব ঘটনার ঘনঘটা থেকে কি 'পক্ষীরাজের ডিম'কে আগলে রাখতে পারবে ঘোতনরা? নাকি ঘটবে অন্যকিছু, যা অল্পনীয়? তারই উত্তর দেবে 'পক্ষীরাজের ডিম'।
অভিনয় কেমন লাগল?
এই ছবির প্রাণ অর্থাৎ পর্দার 'ঘোতন' মহাব্রত বসু এবার দারুণ ভাবে সাবলীল। নিজের ছন্দেই 'ঘোতন'-এর বয়সন্ধিকে দারুণ ভাবে মেলে ধরেছে পর্দায়। 'ঘোতন' এখন আগের থেকে অনেক পরিণত, অনেকটা বোঝে কিন্তু এখনও তার মনে বেঁচে আসছে রূপকথার রাজ্য। বয়সের এই অস্থিরতাকে নিজের মতো করেই অসাধারণ অথচ সহজ করে তুলে ধরেছে মহাব্রত। অন্যদিকে, 'পপিন্স' অর্থাৎ অনুমেঘা বন্দোপাধ্যায়ের বুদ্ধিদীপ্ত কথা আর সারল্যে ভরা এক্সপ্রেশান দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাবে। তবে তারা ছাড়াও ছবিতে অন্যমাত্রা যোগ করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এই অনির্বাণকে এর আগে দর্শকরা কখনও পর্দায় দেখিনি, তা জোরের সঙ্গে বলা যায়। 'বটব্যাল'-এর চরিত্রে তিনি যথার্থ। তাঁর এক্সপ্রেশন যেমন পুরো ছবি জুড়ে আপনাকে হাসাবে, তেমনই শেষে তাঁর অভিনয় চোখের কোণে জল আনতে বাধ্য। তাঁর ডায়লগ ডেলেভারি, তাঁর অঙ্গভঙ্গি দর্শকদের মন জুড়ে থাকবে। তাছাড়াও শ্যামল চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে অনির্বাণের রসায়ন, সকলের মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।
ওভারঅল কেমন লাগল?
কিছু কিছু পরিচালক আছেন যাঁরা নিজেদের কাজে ছাপ রেখে যান, অর্থাৎ একটি ছবি দেখে বোঝা যায় যে এটা সেই পরিচালকেরই ছবি সৌকর্য বিষয়টা একেবারে তাই। তাঁর নিজস্ব একটা ধারা আছে পর্দায় গল্প বলার। সেখানে সারল্য থাকে, জীবনের সহজতা থাকে, মাটির গন্ধ থাকে, সকলের সঙ্গে মিলে মিশে জীবনটাকে অনুভব করার একটা প্রচ্ছন্ন বার্তা থাকে। এই ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের ছন্দেই সাবলীল ভাবে গল্প বলেছেন সৌকর্য। যা আপনাকে ছেলেবেলায় নিজে যাবে। নতুন করে ভাবাবে এই সিঁড়ি পর সিঁড়িতে উঠতে থাকা জীবনের মাঝেও লুকিয়ে আসছে একটা রূপকথার জগত। যা আশেপাশেই আছে, শুধু কখন ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে নিয়ে বসে তার খোঁজ করতে হবে। তাহলেই মিলবে 'পক্ষীরাজের ডিম'।
ছবির গল্প বেশ মনগ্রাহী। ছবির লোকেশন থেকে দৃশ্য সবই শহরের সবুজহীন গগনচুম্বী দেখে হাফিয়ে ওঠা মনকে একরাশ অক্সিজেন দেবে, দেবে চোখের শান্তি। মন জুড়ে একটা শীতলতা আর অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করবে। তবে ছবির শুরু দিকে কিছু কিছু জায়গা ছুঁয়ে দেখতে খানিক সমস্যা হলেও, ছবি শেষ হতে হতে বুঝতেই পারবেন না কখন এর সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবেন। আপনার অজান্তেই কখন চোখের কোল বেয়ে নেমে আসবে আনন্দের অশ্রু। আর সেখানেই ছবির সার্থকতা। ছবির মূল বিষয় অর্থাৎ অনুভূতি বা আবেগ তা ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একেবারে ভরপুর। আর এই ছবির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হল ছবিটি 'রেনবো জেলি'-এর সিক্যুয়াল ঠিকই, কিন্তু যদি কেউ 'রেনবো জেলি' আগে দেখে নাও থাকেন, তাঁরও ছবিটি একই ভাবে ভালো লাগবে। ফের একবার মনের মধ্যে বেঁচে উঠবে 'রূপকথা', যা আসলে বাস্তবেই লুকিয়ে। আর সেই মনভরা সহজ অথচ সুন্দর আনন্দের ডালি নিয়ে যখন হল থেকে বের হবেন তখন জীবন আরও একবার নতুন ভাবে সহজ সুরে ধরা দেবে।