রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত বোলপুরের শুধু বাংলায় নয় সারা দেশেও বিশেষ পরিচিতি আছে। এককালে এটি ছিল সেলিব্রিটি কেন্দ্র, কারণ সিপিএমের প্রবল প্রতাপশালী নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সাতবার এই আসন থেকে জিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। সোমনাথবাবু প্রয়াত, লাল আভাও এখন অনেকটা ফিকে রাঢ় বঙ্গে। তবুও বোলপুর আসন একটি বিশেষ আকর্ষণকেন্দ্র, যেই কারণে মোদী থেকে মমতা, সবাই এসেছেন এখানে প্রচার করতে। চতুর্থ দফায় ১৩ মে বোলপুরে এখানে ভোটগ্রহণ।
বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রটি বীরভূম জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকসভা কেন্দ্র। ১৯৬৭ সাল থেকে এই লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন সংগঠিত হচ্ছে। এই কেন্দ্রটি এখন তফশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত। বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসের অসিতকুমার মাল। বীরভূম জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রটি কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, আউসগ্রাম, বোলপুর, নানুর, লাভপুর এবং ময়ূরেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ১৫ লক্ষ ৩০ হাজার ৪২৯ জন ভোটদাতা নির্বাচনী অংশগ্রহণ করেছিলেন। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রে ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একে চন্দ ৫ শতাংশের বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন।
১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য জুড়ে সিপিআইএম ২০টি আসন, জাতীয় কংগ্রেস ১৩ টি আসন এবং সিপিআই ৩টি আসন পায়। বোলপুর কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন সিপিআইএম। সিপিআইএম প্রার্থী শরদিস রায় ৩৬ হাজার ৬২৫ ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ১৯৭৭ সালের লোকসভাতে এই কেন্দ্রটি সিপিআইএমের দখলে থাকে। ১০ শতাংশের বেশি ভোটের ব্যবধানেই কেন্দ্র থেকে জয়যুক্ত হন শরদিস রায়। ১৯৮০ সালের লোকসভায় রাজ্যজুড়ে সিপিআইএমের আসন বেড়ে দাঁড়ায় ২৮টি। আরএসপি ৪, সিপিআই ও ফরওয়ার্ড ব্লক তিনটি করে আসন পায়। বোলপুর কেন্দ্রটি থেকে তৃতীয়বারের জন্য জয়যুক্ত হন শরদিস রায়। তারপরে ১৯৮৫ সালে উপনির্বাচনে জিতে দিল্লি যান বিখ্যাত আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফের সিপিআইএম-এর পক্ষ থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুর কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পরপর ছ’বার বোলপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন সোমনাথ চ্যাটার্জী। ২০০৪ সালে সিপিআইএম ইউপিএ সরকারে বাইরে থেকে সমর্থন করলে তিনি লোকসভার স্পিকার পদে নিযুক্ত হন।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রামচন্দ্র ডোম এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে ১ লক্ষ ২৬ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেন। এই নির্বাচনে ৮২ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১৪ সালে সিপিআইএমের দীর্ঘদিনের জিতে আসা আসনটি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে যায়। টিএমসি প্রার্থী অনুপম হাজরা এই কেন্দ্র থেকে ২ লক্ষ ৩৬ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। ৮৪.৮ শতাংশ মানুষ এই নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অসিত কুমার মাল ১ লক্ষ ৬৪০০২টি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। ২০১৯ এর লোকসভায় ৭৯ শতাংশ মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
সাম্প্রতিক ফলাফল ও প্রার্থী পরিচয়-
এবার এক নজরে লিখে দেখে নেওয়া যাক বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রগুলির অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রের ২০২১ সালের ফলাফল। কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট এবং আউসগ্রাম এই তিনটি কেন্দ্রেই ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। বোলপুর কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী চন্দ্রনাথ সিনহা ২২ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। নানুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিধানচন্দ্র মাঝি ৬০০০-এর বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। অন্যদিকে লাভপুর কেন্দ্রে অভিজিৎ সিনহা ১৭,৯৭৫টি ভোটে বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রটিতেও তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অভিজিৎ রায় জয়ী হোন। সার্বিকভাবে লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের নিরিখে বোলপুর কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
তবে এবার খেলা অনেকটাই ভিন্ন বলে মনে করছে বিজেপি। তার কারণ অনুব্রত গড়ে এখন অনুব্রত আর নেই। তিনি আপাতত জেলে। তাঁর অবর্তমানে বীরভূমে তৃণমূল সাংগঠনিকভাবে কিছুটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে আশা বিজেপি প্রার্থী প্রিয়া সাহার। এর আগে দুবার বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়ে হেরেছেন ছাত্র রাজনীতি থেকে দলে আসা প্রিয়া। তবে এবার স্বয়ং মোদী তাঁর হয়ে প্রচার করেছেন। অন্যদিকে অনুব্রত ছাড়া পাবেন বলে দলীয় কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেত্রী। অসিত মাল এবারও প্রার্থী তৃণমূলের। একদা বাম গড়ে সিপিএমের প্রার্থী নানুরের প্রাক্তন বিধায়িকা শ্যামলী প্রধান। গতবারে প্রায় ধসে গিয়েছিল বাম ভোট। এবারও যদি আরও ক্ষয় হয়, তাহলে জমে যেতে পারে বীরভূমের লড়াই। নাহলে ফের দিল্লির পথে পাড়ি দেবেন অসিত কুমার মাল।