গানে-কবিতার সুরে বাঁধা এক কথোপথন, সেই নিয়েই সাজানো একটা সন্ধ্যা। সপ্তাহ তিনেক আগে উত্তপ্ত কলকাতার বুকেই নেমেছিল ‘বারিশ’! এক মঞ্চে বাংলার সঙ্গীত জগতের কিছু খ্যাতনামী, সঙ্গে বাচিক শিল্পীরা একত্রিত হয়েছিলেন। সেই ‘বারিশ'এর স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রীজাত।
আরজি কর আবহে উত্তপ্ত গোটা রাজ্য, শহর জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তার মাঝে এমন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করে কটূক্তি শুনতে হয়েছে শ্রীজাতদের। তিনদিন ব্যাপী আয়োজিত বারিশ-এ অংশ নেন শ্রীকান্ত আচার্য, জয়তি চক্রবর্তী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অনুপম রায়, জয় সরকাররা। তাই কম কটূক্তি, ট্রোলিং শুনতে হয়নি তাঁদের। এর জবাব দিলেন শ্রীজাত।
এদিন ফেসবুকে কবি লেখেন, 'ইদানীং এমন হয়েছে যে, বাঁকা কথা না-শুনলে ঠিক বুঝতেও পারি না, সোজা পথে আছি কিনা। কলকাতা বারিশ ঘোষিত হবার পর থেকে আজ অবধি তাকে ঘিরে যা যা বেকার ছলনাময় কটূক্তি চোখে পড়েছে, যেসব অপটু কুযুক্তির খেলনা চক্রব্যূহে তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, যে-সমস্ত অকর্মণ্য আলস্যময় ট্রোলার্ণবেরা হাতে দেদার সময় পেয়ে খুঁতের অগ্রিম বুকিং চালিয়েছেন, তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, বেশ করছি। এবং, আবার করব। বাঙালিদের মধ্যে কিছু মানুষ চিরকালই কাজ করে, বাকিরা জাজ করে। তবে হাতে-কলমে যাচাই না-ক’রে খোঁটা দেবার এই ব্যাপারটাকে আমি দুর্বলের লক্ষণ বলেই মনে করি। তাই জানাই, এ-বছর যেহেতু প্রচুর মানুষ টিকিট না-পেয়ে ফিরে গেছেন, তাই সামনের বছর থেকে কলকাতা বারিশ আরও বড় কোনও প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হবে, আরও বড় আকারেই। সকলের আমন্ত্রণ রইল। আপনারাও আসুন, একবার পকেটের পয়সা খরচ ক’রে দেখেশুনে পরখ ক’রে তারপর গালিগালাজ করে দেখুন, ভাল লাগবে। এইভাবে ফ্রি-তে আর কতদিন?
শ্রীজাত আপও জানিয়েছেন, এই অনুষ্ঠানের ভাবনা যখন সাজানো হয়েছিল তখন শহরে এমন মন খারাপে মেঘ জমেনি। কবির কথায়, 'বারিশ-এর স্বপ্ন যখন দেখতে শুরু করি, তখনও কলকাতার আকাশে মেঘ জমেনি, পথে পথে নামেনি মিছিল। আর পাঁচটা স্বাভাবিক বছরের মতোই এগোচ্ছিল সময়। লেখালেখির পাশাপাশি একেবারে আনকোরা কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাটাও আমার একরকমের নেশা। তাই নতুন নতুন কাজে জড়িয়ে পড়েছি বারেবারে। কখনও আর-কারও ডাকে সাড়া দিয়ে, কখনও নিজেরই ডাকে। বারিশ ছিল আমার অনেকদিনের ডাক, নিজের প্রতি। সাড়া দিতে একটু দেরি হলো, এই যা।
প্রতি শীতে কলকাতা উপচে ওঠে হরেক রঙের আয়োজনে, কিন্তু যে-বর্ষা আমাদের শিল্পচর্চার অনেকখানি জুড়ে থেকেছে চিরকাল, তাকে সেভাবে উদযাপনের সুযোগ ঘটে না, এ ছিল আমার বরাবরের আক্ষেপ। প্রাকৃতিক কারণেই, বর্ষায় যে-কোনও ধরনের বড় আয়োজন করবার অনেক অসুবিধে এবং ঝুঁকি থাকে ঠিকই, কিন্তু এ-দুটো ব্যাপার না-থাকলে কাজ ক’রে আর মজা কোথায়? তাই ইচ্ছে ছিল, কেবল বর্ষাকে কেন্দ্র ক’রে এমন এক উৎসব আয়োজন করবার, যেখানে শিল্পের নানা শাখা’র সংমিশ্রণে বর্ষাকেই সাজিয়ে তোলা হবে। কবিতা থেকে ক্যানভাস, থিয়েটার থেকে শাস্ত্রীয় সংগীত, আড্ডা থেকে আলোচনা, লোকগান থেকে রবীন্দ্রনাথের গান ও লেখা, ঠুমরি থেকে ঠাসবুনোটের বক্তব্য, সিনেমা থেকে ছোটগল্প, সবই থাকবে এক ছাতার তলায়, আর সেই ছাতাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে ঝমঝম বৃষ্টি'।।
বারিশের সাফল্যের জন্য প্রিয়জন থেকে স্পনসর, সকলকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি শ্রীজাত। একই সঙ্গে ভোলেননি শ্রোতাদের ঋণ। কবির কথায়, ‘চরম উত্তাল দুঃসময়ে প্রতিবাদে জেগে ওঠা মানুষও দিনের শেষে শিল্পের কাছেই আশ্রয় নেয়। এ সত্যি যে চিরকালীন, ওই তিনদিনে ঘর ভরিয়ে দেওয়া শ্রোতারা তা প্রমাণ করলেন। এবং হ্যাঁ, রীতিমতো টিকিট খরিদ ক’রে। বিনামূল্যের শিল্পে আমার অনাস্থা আছে বরাবর। শ্রোতারাও দেখিয়ে দিলেন, মনমতো অনুষ্ঠান পেলে তাঁরা অর্থমূল্য ব্যয় করতে রাজি। অতএব, বাংলায় সিনেমা ছাড়া অন্য কিছু লোকে পয়সা দিয়ে দেখতে বা শুনতে যায় না, এর বিরুদ্ধেও কলকাতা বারিশ একটি উদাহরণ হয়ে থাকল। উপর্যুপরি এই তীব্র অস্থির সময়ে, যখন মনমেজাজ থেকে পথঘাট, সবই প্রায় বন্ধ। বারিশ-এর দরজা ছিল খোলা আর ঘর ছিল ভর্তি। শ্রোতারা যেভাবে নতুন এই উদ্যোগকে আলিঙ্গন করলেন, তার জন্য কোনও কুর্নিশই যথেষ্ট নয়’।
আগামী বছর নতুন রূপে সেজে উঠবে বারিশ, সেই কথাও দিলেন তিনি। শ্রীজাত ফেসবুকের দেওয়ালে লেখেন,'২০২৫-এর বর্ষাও সেজে উঠবে নতুন রঙের মেঘে, তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বৃষ্টি যেন আমাদের সব কালিমা ধুয়ে নিয়ে আবার কোনও এক পরিষ্কার আকাশের নীচে দাঁড় করাতে পারে, এটুকুই আমাদের চাওয়া। আমি জানি, আপনাদেরও।'