'রেনবো জেলি'র পর ফিরছে ‘ঘোতন’,‘পপিন্স’রা এবার তাঁদের হাতে পক্ষীরাজের ডিম। যেখানে বিজ্ঞানী 'বটব্যাল'-এর চরিত্রে দেখা মিলবে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের। ১৩ জুন মুক্তি পাবে ছবি, তবে 'পক্ষীরাজের ডিম'-এর ম্যাজিক দর্শকদের সামনে আসার আগেই হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে মজার আড্ডায় মেতে উঠেছিল পর্দার 'বটব্যাল' অনির্বাণ ও পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল।
'পক্ষীরাজের ডিম'-এর ট্রেলার দেখেই দর্শকদের একাংশের দাবি তাঁরা নাকি ফিরে গিয়েছেন ফেলে আসা ছোটবেলায়। কাজটা করতে গিয়ে অনির্বাণ কি ছোটবেলাকে ফিরে পেলেন? প্রশ্নে নায়ক বলেন, 'আমাদের সকলের মধ্যেই আমাদের ছোটোবেলাটা থাকে। সে রকম কিছু একটা জিনিস বা গল্প যদি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়, তাহলে ছোটবেলার কথা মনে পড়েই যাই। আমার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পড়ার, শঙ্কু পড়ার স্মৃতি বা বিদেশী কিছু কল্পবিজ্ঞানের ছবি দেখার যে স্মৃতি সেটা সৌকর্যর চিত্রনাট্যটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল। আমাকে অনেক ভেবেচিন্তে ছোটবেলায় পৌঁছে যেতে হয়নি।'
তবে এই চরিত্রের জন্য ডাক পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিলেন নায়ক। তাঁর কথায়, 'সৌকর্য যখন আমাকে এরকম একটা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বলেছিলেন, সেটা শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস হয়নি বলবো না। তবে প্রথমটা খুব আশ্চর্যই হয়েছিলাম। তখন আমি ওঁকে বলেও ছিলাম যে, 'সত্যি তুমি এরকম চাইছো? কারণ আমার বয়স তো এতটা নয়, আমাকে আরও অন্যরকম কিছু করতে হবে।' তো সব মিলিয়ে ছবিটা করতে গিয়ে ছোটবেলায় ফিরে যাওয়ার থেকেও বেশি যেটা বলা যেতে পারে যে, ছবিটার ক্রিপ্ট রিডিং থেকে ডাবিং পর্যন্ত সবটাই ছিল খুব আনন্দদায়ক। শুধু গরমটুকু ছাড়া। কারণ আমরা শ্যুটিং করেছি গরমে।'
তবে ছোটবেলার কথা এলেই পিছু পিছু আসে অঙ্কের কথা। ট্রেলারে দেখা গিয়েছে 'ঘোতন'-এর বেশ অঙ্কে ভয় রয়েছে, সেটা কী অনির্বাণ আর সৌকর্যর জন্যও প্রযোজ্য ছিল? প্রশ্নে একরাশ হেসে অনির্বাণ বলেন, 'আমিই ঘোতন। আমার অঙ্ক মানে সাংঘাতিক, সৌকর্য অবশ্যই ভালো অঙ্কে।' আর এ কথা শুনেই অনির্বাণের মুখের কথা শেষ করতে যা দিয়েই পরিচালক বলে ওঠেন, 'আমার রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে না। আমি জীবনে একবছর বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার চেষ্টা করেছি, তারপর আর্টসে ফিরে এসেছি। আমার ট্র্যাক রেকর্ডে হচ্ছে আমি প্রথম ইউনিট টেস্টে শূন্য পেয়েছিলাম, হাফইয়ারলিতে ১০০-এ শূন্য, আর ফাইনাল পরীক্ষায় ২০০-এ শূন্য। এটা কেউ ভাঙতে পারবে না।' এইসব শুনে অনির্বাণ পাশ থেকে বলেন, 'ও তো তবু চেষ্টা করেছে, আমি মাধ্যমিকেই পাশ নম্বর ৩৪, সেটা পেয়েছিলাম। তারপর আমি কোনও দিন অঙ্কের দিকে তাকাইনি।'
তবে ভয় যতই থাকুক অভিভাবকরা সব সময়ই অঙ্ক নিয়ে চাপ দিতে থাকে। তার জন্য বকা-ধমকও জোটে। অনির্বাণ-সৌকর্যদের সঙ্গেও কি তাই ঘটত? প্রশ্নে অনির্বাণ বলেন, 'বোকে আমার কিছু হত না। আমাকে বোকে, মেরে, ভালোবেসে, খেতে না দিয়ে কিছু করেই আমার অঙ্কে উন্নতি হয়নি।'
তবে এই গল্পে অনির্বাণের চরিত্র একেবারেই বিপরীত। অঙ্ক আর বিজ্ঞানই অনির্বাণ থুড়ি পর্দার 'বটব্যাল'-এর জীবন। তবে 'বটব্যাল' বয়সের দিক থেকে তো বটেই, বাকি অনেক দিক থেকেই নায়কের থেকে আলাদা। পর্দায় 'বটব্যাল' হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল? 'এক্ষেত্রে সব থেকে বড় সাহায্যটা পাই সৌকর্যর আঁকা ছবি থেকে। সৌকর্য প্রথমেই আমাকে বটব্যালের একটা স্কেচ দেখায়। আর সেই ভাবেই আমাদের রূপসজ্জা শিল্পী অভিজিৎদা আমাকে এমন করে সাজিয়ে তুলেছিলেন। এটাই আমাকে 'বটব্যাল' হতে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছিল, ভাবতে বা কল্পনা করতে যে এর হাঁটাটা, বলাটা, অঙ্গভঙ্গিটা কেমন কেমন হতে পারে। তাছাড়াও আমরা সৌকর্যর বাড়িতে গিয়ে ছোটো ছোটো করে দৃশ্যগুলো রিহার্সাল করতাম।'
অনির্বাণের কথা প্রসঙ্গে সৌকর্য বলেন, 'পুরোটা আমার ক্রেডিট নয়। হ্যাঁ আমি আঁকতে পারি, তাই আমি স্টোরি বোর্ডও করি। কিন্তু আমি পারি বলে তাই করি, আর কিছুই না। তবে এই ছবিটা ট্রেলারে যে ভাবে দেখা যাচ্ছে তা টিমওয়ার্ক। এটা শুধু আমার মাথা থেকে এসেছে তা নয়, আমার স্ত্রী পূজা ও এই ছবির ক্রিয়েটভ ডিরেক্টর। আমরা এই ছবিটা বেঁচেছি। এই যে বটব্যালের দু'হাতে দুটো ঘড়ির কথাই পূজাই বলেছিল। সেটা শুনে আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, যেটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, দুটো ঘড়ি দুটো টাইম জোনের হতে পারে। চুলটা নিয়েও আমরা অনেক ভেবেছিলাম। অনির্বাণ একটা শ্যুটিং করছিলেন, আমরা সেই সেটে গিয়ে অনির্বাণকে পরচুলা পরিয়ে দেখেছিলাম। সবটা মিলিয়ে এটা একটা টিম ওয়ার্ক। আমি, পূজা এবং আমাদের ডিওপি সৌমিকদা আমরা তিনজন মিলে প্রি-প্রোডাকশনে অনেকটা সময় দিয়েছিলাম। আর এখন শ্যুটিংয়ে খুব অল্প সময় পাওয়া যায়, রিহার্সাল আমরা এই কারণেই করতাম যাতে অভিনয়টা নিয়ে আমাদের সমস্যা না থাকে। ফ্লোরে টাইমটা আমরা ফ্রেমে,কালার প্যালেটে সময় দিয়েছি।'
তবে এই ছবি 'রেনবো জেলি'-এর সিক্যুয়াল। 'রেনবো জেলি'তে সাত রঙের সাত জেলি দেখানো হয়েছিল আর তার সঙ্গে ছিল স্বাদের একটা যোগ। সেই জায়গা থেকেই কি এবার 'পক্ষীরাজের ডিম'কে বেছে নেওয়া? প্রশ্নে পরিচালক বলেন, 'সূর্যের সাত রং। ওই সাত রঙের সূত্র ধরেই পক্ষীরাজের ডিম। তবে আমাদের সঙ্গে সাতের একটা যোগ রয়েছে, খুব অদ্ভুত ভাবে সাত বছর পরই আমাদের ছবিটা হল। প্রফেসর শঙ্কুর একশিঙ্গ অভিযানে আমরা ইউনিকনের দেখা পেয়েছিলাম। সত্যজিৎ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এঁদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। এই জায়গা থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি যে, কল্পবিজ্ঞানের গল্পে কীভাবে একটা রূপকথার প্রাণীকে ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে।'
কিন্তু ট্রেলারে দেখা গিয়েছে পক্ষীরাজের ডিমের মাধ্যমে মানুষের ইমোশান দেখা যাচ্ছে। এই ভাবনাটা কীভাবে এল? পরিচালকের কথায়, 'এই ভাবনার সূত্রটা রেনবো জেলিতে আছে। রেনবো জেলিতে ছিল যে, সাতটা স্বাদের খাবার বানিয়ে এমন একটা খাবার হবে সেখানে সাতটা স্বাদই থাকতে। সেখানে খারাপ মানুষ ভালো হয়ে যাবে। আমি যখন স্যিকুয়ালটা লিখতে বসলাম তখন ওই জায়গাটা থেকে শুরু করি। যে মানুষটা কেন ভালো হল? লোকটার একটা ভাবনার পরিবর্তন হল। তারপর ভাবনাটা আসে যে, যদি অনুভূতিগুলোকে দেখা যেত তবে সেই ভাবে 'রেনবো জেলি 'তৈরি করা যেত। সেখান থেকেই এই পক্ষীরাজের ডিমের মাধ্যমে ইমোশান দেখা যাওয়ার বিষয়টা আসে।'
কিন্তু অনির্বাণ ও সৌকর্য যদি হাতে পক্ষীরাজের ডিম পায় তবে কার ইমোশান দেখতে চাইবে? প্রশ্ন শুনে অনির্বাণ বলেন, 'জীবনযাপনের মাধ্যমে ইমোশানাল এক্সপিরিয়েন্স হওয়া ভালো। সেটা অনেক বেশি আনন্দের। মানুষের এই যে গোপন করার প্রবৃত্তি এটা আমি ভালোবাসি।আমি তাঁদের লুকিয়ে রাখা অনুভূতিগুলো দেখতে চাই না। কেউ যদি একটা পর্দা নিজের উপর টেনে রাখেন, তা থাক, আমি দেখতে চাই না।' অন্যদিকে সৌকর্যও মত,'আমি প্রযোজকদের অনুভূতি দেখতে চাইব।'
তবে রেনবো জেলির প্রেক্ষাপট ছিল কলকাতা, কিন্তু এবারের গল্পে উঠে আসবে একটা গ্রাম। কীভাবে এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন সম্ভব হল? পরিচালক বলেন, 'রেনবো জেলির শেষে ঘোতন চলে যায় একটা সাধারণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য। তারপরের সাত বছরের গল্প আমরা জানি না। এই সাত বছরে ওকে কলকাতার কোনো স্কুল ভর্তি নেয়নি। শেষে এমন একটা গ্রামে আসে যার নাম আকাশগঞ্জ। সেখানে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা হয়। তো সেই স্কুলে ঘোতন ভর্তি হয়। সেখানে বোর্ডের পরীক্ষায় ঘোতন অঙ্কে ফেল করে। আর আমি তখন ঢুকে পড়ি।'
আসলে ঘোতনদের ঘিরেই এই গল্প। কিন্তু পর্দার ঘোতন মানে মহাব্রত তার সঙ্গে বহু বছর পর আবার কাজ করলেন সৌকর্য। সাত বছরে কতটা বদল হল তার? প্রশ্নে সৌকর্য বলেন, 'ওর সঙ্গে যোগাযোগ তো ছিলওই। তবে কাজটা শুরুর আগে মহাব্রতর মায়ের সঙ্গে যখন কথা বলি, তিনি আমাকে জানান, আগে মহাব্রত কেমন হয়েছে এখন তা যেন গিয়ে দেখার জন্য। গিয়ে দেখি ওর প্রায় ৯০ কিলো ওজন হয়ে গিয়েছে। সেই সময় মহাব্রতকে ডায়েট করিয়ে, ওকে ব্যায়াম করিয়ে, ওর মেদ ঝরানো হয়। তারপর চার মাসের ওয়ার্কশপ চলে। সেটা করে করে ওকে আবার ঘোতনের চরিত্রটার মধ্যে ঢোকাতে হয়।'
অন্যদিকে পর্দার 'ঘোতন-পপিন্স'দের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব অনির্বাণের। নায়কের কথায়, 'এর আগে আমার ছোটোদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি থিয়েটার সূত্রে ছোটদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমার মহাব্রতর সঙ্গে অনেকটা অভিনয় ছিল, তাই ওঁর সঙ্গে আমার একটা চমৎকার বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অনুমেঘার সঙ্গে আমার দৃশ্য কম ছিল। তবে দু'জনের সঙ্গে আমার দু'রকমের নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। আমি মহাব্রত, অনুমেঘা আর শ্যামল চক্রবর্তী আমরা ছিলাম একটা বন্ধুদের গ্রুপ। এবার তাহলে সেটা ঠিক কী রকম হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। পর্দাতেও দর্শকরা তাঁর খানিকটা দেখতে পাবেন। আমাদের পক্ষীরাজের ডিমের সেটটা বিভিন্ন বয়স, বিভিন্ন স্বাদের মানুষজনে ভরপুর ছিল। আমাদের গল্পটা যেহেতু সাত রং নিয়ে, মানুষও ছিল সব নানা রকমের।'